গাজীপুরের কালিয়াকৈরের বংশাাই নদী ঘেঁষা বরইতলি গ্রাম। এই গ্রামে বিদেশ ফেরত এক প্রকৌশলী গড়ে তুলেছেন অর্গানিক মুরগীর খামার। প্রচলিত মুরগীর খামারে যেখানে বানিজ্যিক খাবারের পাশাপাশি নানা ধরনের ওষুধের ব্যবহার হয় সেখানে এই খামারে ব্যবহার করা হয় ভেষজ সামগ্রী। কোন মুরগীর অসুখ হলে কাঁচামরিচ, প্রাকৃতিক বিটেইন,নিমপাতা,বিভিন্ন ধরনের শাক,অ্যাপল সিডার ভিনেগার উইথ মাদার, তুলসী পাতা, আদা, রসুন, সজনে পাতায় মেলে সমাধান। সাথে এই অর্গানিক খামারে তাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিরোধক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। সমন্বয় ঘটানো হয়েছে নানা প্রযুক্তিরও। সাথে গ্রোথ প্রমোটার, মিল বোন মিট ও হরমোন ছাড়া নিরাপদ খাদ্যের যোগানও নিজস্বভাবে তৈরী করা মেশিনের মাধ্যমে তৈরী করা হয়েছে।
একজন প্রকৌশলী হিসেবে আন্তর্জতিক অঙ্গনে সুনামের সাথে চাকুরী ও যুক্তরাজ্যের নাগরিকের সুযোগ ছিল তার সামনে। তবে সব তিনি ত্যাগ করে তিনি দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে ২০১৪সালে ফিরে এসেছে। শুধু এন্টিবায়োটিক মুক্ত মুরগীর মাংস দেশের মানুষের সামনে আনার প্রত্যয় নিয়ে।
কেননা দেশে নিরাপদ মাংস উৎপাদনে এখনও তেমন নজরদারী নেই। বানিজ্যিক কারণে দেশের খামারীরা অধিক পরিমাণে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার করে। এতে একদিকে মানুষের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস হচ্ছে আবার শরীরকে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী করে ফেলছে। তাই নিরাপদ আমিষের যোগানের পথ তিনি তৈরীর প্রচেষ্টা শুরু করেছেন।
প্রকৌশলী ইমরুল হাসানের খামারে বর্তমানে প্রায় চারহাজার মুরগী রয়েছে। এসব মুরগী ব্রয়লার, কালার বার্ড, প্রিমিয়াম রোস্টার প্রজাতির। নির্দ্দিষ্ট সময়ে বিক্রির উপযোগী হলে মুরগীগুলো তিনি নিজস্ব উপায়ে(ইসলামী রীতি অনুযায়ী) প্রস্তুত করে রাজধানী ঢাকায় ফ্রিজিং গাড়ী( শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ী) যোগে অনলাইনে অর্ডার নিয়ে বাড়ী বাড়ী পৌছে দেন।
খামারের তত্বাবধানকারী মনির হোসেন বলেন, এ পথটা শুরু থেকেই মসৃন ছিল না। আমরা ২০২০সালের ডিসেম্বরে প্রথম শুরু করি। প্রথম দুই ব্যাচে কোন সমস্যা ছিল না। তখন ছিল শীতকাল। পরে যখন গরম পরে তখনই হোঁচট খাই আমরা। পর পর দু ব্যাচের অধিকাংশ মুরগী মারা গেল। এতোগুলো টাকা গচ্ছা যাচ্ছে দেখে সবাই তখন স্যারকে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দেয়। স্যারের জবাব ছিল “না”। এর পরই মূলত স্যারের চিন্তাচেতনায় পরিবর্তন আনেন। কয়েকদিন চিন্তাভাবনার পর স্যার জানান, বয়স ভেদে তাপমাত্রা ভিন্ন রাখেলেই মূলত মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা যায়। এর পর কয়েকমাস বিরতি দিয়ে বায়োসিকিউরিটি গড়ে তুলা হয়। খামার সহ আশপাশ জীবানুমুক্ত করা হয়। স্যারের নিজস্ব চিন্তাচেতনায় নানা ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়। বিশেষ করে অটোমেটিক তাপনিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা। আর এর ফলেই মূলত সফলতা আসে। জিরো এন্টিবায়োটিক করা হয়েছে তাদের খামারকে। আর এখন বৃহত্তর পরিসরে এই খামার সম্প্রসারণের উদ্যোগ। বাড়ীর পাশেই আরো ১৮বিঘা জমি নেয়া হয়েছে। যেখানে উন্মোক্ত অবস্থায় প্রাকৃতিকভাবে মুরগী পালন করা হবে।
অর্গানিক খামারে সার্বক্ষনিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থা,উন্নতমানের খামার ও ভালোমানের টিকার কারণে মুরগীর মাংস উৎপাদন খরচও তুলনামূলকভাবে বেশী হয়। ব্রয়লার মুরগীতে সাধারণ খামারীর তুলনায় ৮৮শতাংশ আর কালার বার্ডে ৬৮শতাংশ খরচ বেশী হয়। তাই এর বাজারমূল্য বেশী হয়।
ইমরুল হাসান ২০০৩ সালে বুয়েট থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। দীর্ঘদিন তিনি দেশে ও বিদেশে টেলিকম ওতথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতে সুনামের সাথে চাকুরী করেন। পেশাগত কারণে তিনি যুক্তরাজ্য,মিশর, ফিলিপাইন, আরবআমিরাতে চাকুরী করেন। দেশে ফিরে তথ্যপ্রযুক্তি, পর্যটন ও কৃষিভিক্তিক উদ্যোগের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন।
প্রকৌশলী ইমরুল হাসান বলেন, নতুন প্রজন্মের কাছে মাংস খুবই জনপ্রিয় খাবার। অথচ দেশে এখনও নিরাপদ পোলট্রি মাংস উৎপাদনে নজরদারী গড়ে উঠেনি। পোলট্রিখামারে বানিজ্যিক খাবার ও অধিক পরিমাণ ও অযোচিত এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে আমাদের জীবনের জন্য হুমকী তৈরী হচ্ছে। তাই নিরাপদ মাংস উৎপাদনে খামারীদের আগ্রহ তৈরী ও নিরাপদ মাংস পৌছে দিতেই তিনি অর্গানিক খামার গড়ে তুলেছেন। আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই নিরাপদ খাবার খুবই জরুরী। একটি সুন্দর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিরাপদ মাংস উৎপাদন এখন আমাদের হাতের মুঠোয়।
তিনি আরো বলেন তার দেখাদেখি অনেকেই এখন এমন অর্গানিক খামার গড়ে তুলতে পরামর্শ চান তার কাছে। তিনি তাদের পথ দেখাচ্ছেন।
গাজীপুর জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ উকিল উদ্দিন বলেন, আমাদের এলাকায় প্রান্তিক খামারীরা যখন এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন তখন আমরা নির্দেশনা দেই ডোজ শেষ হওয়ার ১০দিন পর মুরগীগুলো বিক্রি করার। আর না হলে তা মানুষের শরীরে ঢুকে ক্ষতি করবে। সরকার এগুলো বিভিন্নভাবে নজরদারীর চেষ্টা করছে। তবে জিরো এন্টিবায়োটিক সত্যিই ভালো দিক। যেখানে শতভাগ অর্গানিক। এখানে কোন ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। আর আমরা প্রতিনিয়তই স্বাস্থ্য সচেতন হচ্ছি এর ফলে এখন অনেকেই অর্গানিক খাদ্য পণ্য অধিক দামে কিনতে কুন্ঠাবোধ করে না। যেহেতু গাজীপুরে জিরো এন্টিবায়োটিক অর্গানিক খামার গড়ে উঠেছে তাই এখন অনেকেই এতে উৎসাহিত হবে। আমরা এমন খামারীদের পাশে থেকে সহায়তা করবো।
Courtesy: স্বদেশ প্রতিদিন/নিশাদ
https://www.swadeshpratidin.com/details.php?id=72390